সময়টা ১৯৮৪ সাল। একদিন ভোরে বাসা থেকে বেরিয়ে কাজে যাচ্ছিলেন তরুণ নূর হোসেন। সড়ক ধরে কিছুটা এগোতেই তাঁর কানে ভেসে আসে একটি শি’শুর কা’ন্না। থমকে দাঁড়ান তিনি। শি’শুটির কা’ন্নার শব্দ যেদিক থেকে ভেসে আসছিল, এক পা, দু-পা করে সেদিকে এগিয়ে যান। মুহূর্তেই বুঝে যান, কা’ন্নার শব্দটি আসছে ডাস্টবিন থেকে। স্থান পুরান ঢাকার টিপু সুলতান রোড। ডাস্টবিনের পাশে গিয়ে দেখেন সেখানে একটি ন’বজাতক। কালবিলম্ব না করে শি’শুটিকে পরম মমতায় কোলে তুলে নেন নূর হোসেন।
এরপর সোজা হাঁটা দেন বাসার দিকে। স্থানীয় পুলিশকে বি’ষয়টি জানান তিনি। ওই সময় নূর হোসেন যে বাড়িতে থাকতেন, সে বাড়িতে থাকতেন নিঃস’ন্তান দম্পতি ফজলু ও জরিনা। তাঁদের কোলে তুলে দেন তিনি শি’শুটিকে। পরে তার নাম রাখা হয় ময়না। সেই থেকে ৭৯/১ বনগ্রাম রোড, ওয়ারীর ওই বাড়ির একটি কক্ষে বড় হয়ে ওঠে কুড়িয়ে পাওয়া ময়না। ওই বাড়ির দুটি কক্ষে নূর হোসেন তাঁর মা-বাবা ও পাঁচ ভাই-বোন নিয়ে বাস করতেন। তিন বছর পর ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের আজকের এই দিনে (১০ নভেম্বর) অসামান্য মানবিক গুণের অধিকারী তরুণ নূর হোসেন গণতন্ত্রের জন্য বুকের তাজা র’ক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন রাজধানীর রাজপথে। এরপর ইতিহাসে নূর হোসেনের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয় স্বৈ’রাচারবি’রোধী আন্দোলনের অকুতোভ’য় সৈনিক, গণতন্ত্রের জন্য আত্মদানকারী কিংবা শহীদ নূর হোসেন হিসেবে। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায় ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’।
কুড়িয়ে পাওয়া শি’শুটিকে নতুন জীবন দিয়েছিলেন গণতন্ত্রের জন্য শহীদ নূর হোসেন। এই তথ্যটি এখনো তাঁদের প্রতিবেশীদের অনেকে জানেন না। ফজলু ও জরিনা দম্পতি পরম মমতায় এই সত্য আগলে রাখেন। শি’শু ময়নাও পরিচিত হয়ে ওঠে ফজলু-জরিনা দম্পতির একমাত্র কন্যা হিসেবে। দরিদ্র পরিবারটির অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠলেও বর্তমানে অনেক ভালো আছেন ময়না। স্বামী আলমগীর, মেয়ে আঁখি ও ঝর্ণা এবং ছেলে মারুফকে নিয়ে এখন ময়নার সুখের সংসার। স্বামী আলমগীর র’ড, অ্যালুমিনিয়াম ও পিতলের ব্যবসা করেন। তিন বছর আগে বড় মেয়ে আঁখিকে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই আরমান শ্বশুর আলমগীরের সঙ্গে ব্যবসা দেখাশোনা করেন।
শহীদ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নূর হোসেন অত্যন্ত কোমল মনের মানুষ ছিল। সে শুধু গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেনি, মানুষের বি’পদে-আপদে সবার আগে ছুটে যেত। মানুষের উপকার করতে পারলে খুব খুশি হতো।’
তিনি আরো বলেন, ‘শহীদ হওয়ার তিন বছর আগে নূর হোসেন ডাস্টবিন থেকে ময়নাকে কুড়িয়ে এনে পুলিশকে জানিয়ে জরিনার কোলে তুলে দেয়। সেই ময়না এখন খুব সুখে আছে। আমি তার নানি। নূর হোসেন ও আমার ছেলেরা তার মামা। একটু বড় হলে ময়না যখন নূর হোসেনের শহীদ হওয়ার কথা জানে, খুব মন খা’রাপ করত।’
মিরপুর মাজার রোডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া এক টুকরো জমিতে অনেক ক’ষ্টে দোতলা বাড়ি করেছেন মরিয়ম বিবি। সেই বাড়িতে বড় ছেলে আলী হোসেন, মেজো ছেলে দেলোয়ার হোসেন, ছোট ছেলে আনোয়ার হোসেন এবং তাঁদের স’ন্তানদের সঙ্গে কাটছে মরিয়ম বিবির সময়। তাঁদের একমাত্র মেয়ে শাহনা বেগম স্বামীর সঙ্গে অন্যত্র বাস করেন। এই জমি পাওয়ার আগে তাঁরা টিপু সুলতান রোডের পাশে ৭৯/১ বনগ্রাম রোডের বাসায় থাকতেন।
গতকাল বনগ্রাম রোডের ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় শহীদ নূর হোসেনের মামাতো বোন ফরিদা বেগমের সঙ্গে। ফরিদা বেগম আর শহীদ নূর হোসেনের কুড়িয়ে পাওয়া শি’শু ময়না একসঙ্গে এই বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন। ময়নার মা জরিনা আর বাবা ফজলু মা’রা গেছেন বলে জানান ফরিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘মা জরিনা বেঁচে থাকতেই চাচাতো ভাই আলমগীরের সঙ্গে ময়নার বিয়ে হয়। ওরা অনেক ভালো আছে।’
ময়নার স্বামী আলমগীর গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিয়েতে আমার পরিবার রাজি ছিল না। তার পরও আমি ময়নাকে বিয়ে করেছি। কারণ এ বি’ষয়ে তার কোনো হাত ছিল না। আমি তার সব কিছু জানতাম। আমার চাচা-চাচি তাকে মানুষ করেছেন। সব জেনে-শুনে ময়নাকে বিয়ে করে আমি অনেক সুখী।’