দুই দশক পর আফগানিস্তান ফের তালেবানের কব্জায় চলে এসেছে। সোমবার (১৬ আগস্ট) আফগানিস্তানে চলমান যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে তালেবান। প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির দেশত্যাগ ও রাজধানী কাবুল অধিকার করে নেওয়ার পর এ ঘোষণার কথা জানান তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ নায়েম।
আফগান যুদ্ধের পেছনে কে কত খরচ করেছে?
২০০১ সালে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের সামরিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো।
গত জুলাইয়ে রাতের অন্ধকারে প্রায় চুপিসারে আফগানিস্তান ছেড়ে যান মার্কিন সেনারা। এর মাত্র ৬ সপ্তাহ পার হতে না হতেই ফের আফগানিস্তান দখলে নিল তালেবান। ১৯৭৫ সালে যেভাবে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে মার্কিন সেনাদের হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তেমনি ২০২১ সালে কাবুলে সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব মতে, দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধে ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি। আফগান সেনা ও পুলিশ নিহত হয়েছেন আনুমানিক ৬৪ হাজার। বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত সোয়া লাখের মতো।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান যুদ্ধের ব্যয়ভারের বড় অংশটি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশটিতে এক লাখের বেশি সেনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। এ সময়ে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার খরচ হতো।
ব্রোয়ন ইউনিভার্সিটির ২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র দেশটিতে ৯৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার খরচ করেছে।
তবে ওই গবেষণাতে এটিও উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধের সার্বিক খরচ নিরূপণ করা কঠিন। কারণ সরকারের নানা দপ্তরের হিসাব রাখার আলাদা আলাদা ধরন রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তনও হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরেই আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি সেনা রয়েছে যুক্তরাজ্য ও জার্মানির। যুক্তরাজ্য আফগানিস্তানে ৩ হাজার কোটি আর জার্মানি এক হাজার ৯০০ কোটি ডলার খরচ করেছে বলে ধারণা করা হয়।
তালেবানের কাবুল দখল করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তানে ২০ বছরের মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর উপস্থিতির পরিসমাপ্তি ঘটল। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাসের সব কর্মীকে সরিয়ে নিতে পেরেছে বলে জানিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশও তাদের কর্মীদের সরিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রতিবাদে হোয়াইট হাউসের সামনে বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক শ’ সাধারণ মানুষ। এ সময় তারা আফগানিস্তানের পক্ষে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
আফগানিস্তানে চলমান সহিংস পরিস্থিতির জন্য বাইডেন প্রশাসনকে দায়ী করেন বিক্ষোভকারীরা। তারা বলেন, এত দ্রুত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণেই দেশটিতে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
অন্যদিকে, তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই রোববার (১৫ আগস্ট) আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে গেছেন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েকজন সশ্রস্ত্র তালেবান প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঢুকে নিয়ন্ত্রণ নেয়।
দেশ ছেড়ে পালানোর আগে গনি ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে লেখেন, ‘আমাকে সরিয়ে দিতে তালেবানরা পুরো কাবুল ও বাসিন্দাদের ওপর হামলা করতে এসেছে। রক্তপাত এড়াতে দেশ ছেড়ে যাওয়া ভালো হবে বলে আমি মনে করেছি।’
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য প্রত্যাহারের পর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। সেই যুদ্ধেই তালেবানের উত্থান। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল তাদের দাপট। সংগঠনটি আফগানিস্তানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে সংগঠনটি একই সঙ্গে আফগানিস্তানে ইসলামি অনুশাসনও চালু করে।
১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইসলামি শরিয়া শাসনের পাশাপাশি চালু করে নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়। সে সময় থেকে নিষিদ্ধ করা হয় টিভি, গান ও সিনেমা। আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সংগঠিত হয় তালেবান। তাদের প্রায় ৮৫ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়। ২০০১ সালের পর এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় সশস্ত্র এ গোষ্ঠী।